fbpx

FIGHT AGAINST CORONA

বাতাসে বাতাসে টেস্টের আগেই ছড়িয়ে পড়লো ‘আমার করোনা হয়েছে’। সোশাল মিডিয়াতে, ফোনে, আমাকে এবং আমার কাছের আত্মীয়-স্বজনকে অসংখ্য মানুষ নক করতে থাকলেন। তাদের এই সারাক্ষনের সাবধান বাণী আমাকে ভীত করলো। আমি ডিসিশন নিলাম টেস্টের রেজাল্ট কাউকে বলবো না।

"আমার করোনাকাল" by TONMOY CRUZE

‘সোশ্যাল স্টিগমা’ শব্দটির সাথে আমার পরিচয় প্রায় এক যুগ। Tony Michael দার সাথে এইডস বিষয়ক একটা স্টিগমা ক্যাম্পেইনে ২০০৭/০৮ সালের দিকে আমার এ শব্দটির সাথে পরিচয় হয়। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ জানতাম। তবে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে এই করোনা মহামারীর সময়ে নিজের একটা অভিজ্ঞতা হবে ভাবতে পারিনি। একজন ‘এক্স-কোভিড-১৯ পজেটিভ পেশেন্ট’ হিসেবে আজকে আমি কিছু কথা শেয়ার করবো। লেখাটা একটু বড় হবে। তবে ধৈর্য্য নিয়ে পড়লে, আশা করি কাজে আসবে।

২৫ মার্চ, ২০২০ থেকে শুরু হয় আমার লকডাউন পিরিয়ড। মা অতিমাত্রায় সচেতন হওয়াতে খুব কড়াকড়ি ভাবে লকডাউন মেনে চলছিলাম সবাই। ভাগ্যক্রমে হাসপাতালের ডিউটি থেকে বাবাও একটা লম্বা ছুটি পেয়ে যায়, তাই প্রাথমিকভাবে একটু মানষিক শান্তিতে ছিলাম। পুরো এপ্রিল মাস জুড়ে আমরা সবাই ঘরেই ছিলাম। তবে বাজার এবং ওষুধ কেনার জন্য আমাদের ২-৩ দিন ঘরের বাইরে বের হতে হয়। তবে বাইরে বের হবার সময় আমাদের মাস্ক, গ্লাভস এবং ‘শারীরিক’ দূরত্ব সহ অন্যান্য স্বাস্থ্য নির্দেশনা মেনে চলা নিশ্চিত করি। মে মাসের ৪ তারিখ হঠাত আমার বাবা এবং মায়ের এক সাথে জ্বর আসে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা ভয় পেয়ে যাই। তবে মনোবল না হারিয়ে আমরা সবাই চারটি আলাদা রুমে নিজেরদের আইসোলেটেড করি। মায়ের আগে থেকেই কিছুটা ব্রিদিং ইস্যু ছিল, সেটার পাশাপাশি খুব হালকা জ্বর(৯৮.৫-৯৯.৫) থাকে। কিন্তু তার কোন গলা ব্যাথা কিংবা কোভিডের অন্যান্য উপসর্গ দেখা যায় না। এবং আশার কথা হল দু’দিনের মাথায় সে সেরে ওঠে। কিন্তু বাবার জ্বর আর ভালো হয় না। বলে রাখা ভালো, ৯৮.৫ থেকে ১০২ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর ওঠানামা করতো। বেশিরভাগ সময়ে জ্বর থাকতো খুব কম। কিন্তু দূর্বলতা, গলা শুকিয়ে যাওয়া এবং বুকে হালকা চাপের সাথে হালকা শ্বাসজনিত সমস্যা হত। পারিবারিক ডাক্তারের পরামর্শে প্রথম ৫ দিন বাবা এজিথ্রোমাইসিন কোর্স এবং জিঙ্ক খাওয়া শুরু করেন। কিন্তু ৫ম দিনেও জ্বর ভালো না হওয়ায় আরো দুদিন এজিথ কন্টিনিউ করেন। উল্লেখ্য এই সময়ে ঘরোয়া পদ্ধতিতে আমাদের অন্যান্য চিকিৎসা চলতে থাকে; যেমন প্রতিদিন গরম পানিতে গারগেল করা, প্রচুর ভিটামিন সি খাওয়া, সকাল-বিকাল গরম মসলা, আদা ও লেবুর গরম পানি খাওয়া, উষ্ণ ভাপ নেয়া এবং গরম পানিতে গোসল করানো। এই সময়ে প্রচুর পুষ্টিকর খাবার তাকে দেয়া হয়(দুধ, ডিম, স্যুপ, তাজা ফলমূল ইত্যাদি)। জ্বর ভালো না হওয়াতে আমরা ৩৩৩ এ কল করি। সেখানে প্রাথমিকভাবে লাইন পেতে একটু অসুবিধা হয়, তবে আমরা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পারি। ডাক্তার আমাদের সব কিছু শুনে আমাদের ঘরোয়া পদ্ধতিতে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে বলেন(যেহেতু কোন শ্বাসকষ্ট কিংবা অন্যান্য মেজর কমপ্লিকেসি নেই)। ঐ সময় উপসর্গ অনুযায়ী ডাক্তার বাবাকে সেপ-৩, অমিডন এবং ভাইটালজিন প্রেসক্রাইব করেন। ডাক্তারের পরামর্শে আমরা তখনই টেস্ট না করানোর সিদ্ধান্ত নেই। প্রাথমিকভাবে টেস্ট করাতে গিয়ে আমরা আসলে রোগটাকে ঘরে বয়ে নিয়ে আসতে চাইনি কারন তখনো সামিজিক দূরত্ব বজার রেখে টেস্ট পদ্ধতি চালু হয়নি। বাবা ওষুধগুলো রেগুলার খেতে থাকেন এবং ঘরোয়া চিকিৎসায় ১৮-১৯ তারিখের দিকে তিনি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন। বলে রাখতে চাই তখনো তার আইসোলেশন আমরা নিশ্চিত করি।

এবার আসি স্টিগমার কথায়। বাতাসে বাতাসে টেস্টের আগেই ছড়িয়ে পড়লো ‘আমার করোনা হয়েছে’। সোশাল মিডিয়াতে, ফোনে, আমাকে এবং আমার কাছের আত্মীয়-স্বজনকে অসংখ্য মানুষ নক করতে থাকলেন। তাদের এই সারাক্ষনের সাবধান বাণী আমাকে ভীত করলো। আমি ডিসিশন নিলাম টেস্টের রেজাল্ট কাউকে বলবো না। কারন প্রথমত, মরনব্যাধী নিয়ে হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলা আসলেই খুব ডিফিকাল্ট। যারা আসলে এই সিচুয়েশনে পরে নাই, তারা আসলে এটা বুঝতে পারবে না। আমি আশেপাশের মানুষের স্বান্তনা দেয়ার স্টাইল দেখেই বুঝে ফেললাম, আমার রেজাল্ট যদি তারা কোনভাবে জানে, আমাকে সাহায্য করার বদলে তারা ‘একঘরে’ করে ফেলবে। যদিও আমি একঘরেই ছিলাম, কিন্তু জীবন-জীবিকার তাগিদে আমার পরিবারের কাউকে হয়তো বাইরে যেতে হয়েছে। আমি চাইনি তারা বৈষম্যের শিকার হোক। তারপরেও খুব কাছের কতিপয় ব্যক্তি ব্যপারটি জেনে না জেনে অনেক অতিরঞ্জিত করে অনেকের কাছেই অনেক ভুল তথ্য দিয়েছেন। তার ফলশ্রুতিতে ফোন কলের পর ফোন কল এবং অসংখ্য মেসেজের রিপ্লাই আমাকে দিতে হয়েছে। সত্যি বলতে কি, ঐ মুহুর্তে অনেকে হয়তো ভাল ভেবেই কল করেছেন খোজ নিয়েছেন, অনেকে দোষ দিয়েছেন, অনেকে ওষুধ সাজেস্ট করেছেন, কিন্তু আমার মানষিক অবস্থা সেটা নেবার মতন ছিল না। একা একটা ঘরে থেকে মরণব্যাধী থেকে ফিরে আসার স্ট্রাগল আসলে যে করে কেবল সেই বোঝে। আপনাদের সবার কাছে অনুরোধ থাকবে, এই করোনাকালীন সময়ে নিচের কয়েকটি বিষয় মনে রাখবেন,

১. অযথা রোগীকে ফোন করবেন না। রোগী কিংবা তার পরিবার যদি নিজ থেকে যোগাযোগ করে, তাকে সাহস দিন। এমন কিছু করুন যাতে তার আপনার সাথে আলাপ করে ভালো লাগে। পুরোনো স্মৃতি নিয়ে আলাপ করতে পারেন।

২. কিভাবে তিনি এই রোগ বাধাঁলেন সেটা জানতে চাইবেন না। কারন এইটার সঠিক উত্তর একজন রোগী কখনোই দিতে পারবেন না এটা গ্যারান্টেড।

৩. ওষুধ প্রেসক্রাইব করবেন না। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি ডাক্তার তার জায়গা থেকে, রোগীর উপসর্গ বুঝে তাকে সাধ্যমত সাহায্য করে যাচ্ছেন। তাদের উপর বিশ্বাস রাখুন। তাদের কাজটা তাদের করতে দিন।

৪. সাস্পেক্টেড রোগীর তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াবেন না। কোন কনফিউশন থাকলে সরাসরি আলাপ করুন। এতে করে এই করোনা মহামারি ব্যাপারটি স্টিগমা হয়ে যাচ্ছে।

৫. রোগীর সাথে ভালো আচরন করুন। তাকে আইসোলেশনে থাকতে হেল্প করুন। মনে রাখবেন, আপনাদের অসহযোগিতার কারনে তাকে যদি বাইরে আসতে হয়, তবে সমাজের জন্য ক্ষতি। তার কি লাগবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাকে তা পেতে সাহায্য করুন।

৬. মানষিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহন করুন। এই রোগ যেকোন সময়ে যে কারো হতে পারে। এটা হলেও আপনার কিছু হবে না এমন মানষিকতা তৈরি করুন। শক্ত হোন। মানষিক শক্তি আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে।

৭. ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া কোন ওষুধ খাবেন না, খাবেন না, খাবেন না।

৮. কিছুটা সময় বিভিন্ন মিডিয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। টিভি, ফেসবুক, ইউটিউব খুললেই বর্তমানে করোনার মহামারী সংবাদ দেখা যায়। কিছুটা সময় ঐ জায়গা থেকে নিজেকে আলাদা করুন।

৯. পুষ্টিকর খাবার খান। নিজের ইমিউনিটি স্ট্রং করুন। এক্সারসাইজ করুন।

১০. সামাজিক দূরত্ব নয়, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। স্বাস্থ্যবীধি মেনে চলুন।

১১. করোনার ভালো সংবাদগুলো প্রচার করুন। প্রতিদিন কতজন মারা যাচ্ছে সে নিউজটা শেয়ার করার থেকে কতজন সুস্থ হচ্ছে এটা শেয়ার করুন। এতে সামাজিকভাবে মানষিক শক্তি বাড়বে।

আসুন এই সময়টা এক থাকি। একসাথে পাশে থেকে এই মহামারী থেকে নিজেদের বাঁচাই।

করোনাকে ভয় নয়,
মানষিক শক্তি আর সাবধানতায়
করোনাকে করবো জয়!

২৩ জুন, ২০২০
মহাখালী, ঢাকা।