কালাচাঁদপুর ব্রীজে সন্ধার পর আমরা প্রায় আড্ডা দেই । শামীমের দোকানে রাজনীতির আলাপ নিষিদ্ধ । একটা ভাংগা টুল, দাড়িয়ে থেকেই আমরা ঘন্টাখানেক পার করে দিতাম । অফিস শেষে ক্লান্ত শরীরটা যেন নিমিষেই শক্তি এনে দিত । আমি, সোহাগ, মঈন আর তন্ময়, বন্ধুদের গল্প কোনদিন শেষ হত না । মঈন বুয়েটের ছাত্র, পড়াশোনায় সবসময় খুব ভালো ছিল । তার কমপ্লেইন আমাদের জন্য সে লাইফে কিছু করতে পারিনি । কিন্তু আড্ডা শেষে সে একটা তৃপ্তি নিয়ে বাসায় যেত.. “তোরা আছিস বলেই তো এতকিছু” । আমরা সবাই এই এলাকার আশেপাশেই থাকি ।
আমি যে মেসে ভাড়া থাকি, সেখানে রিপন নামে একটা নতুন ছেলে উঠেছে । কোন একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে । তাকে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত পড়ার টেবিল থেকে উঠতে দেখিনি । “আঁতেল পোলাপাইন” । তবে ছেলেটাকে দেখার পর মনে হল খুব স্বাভাবিক পরিবার থেকে এসেছে, ভার্সিটির খরচ চালাতে হিমশিম খায় । সে একটা টিউশনি করায়, মাঝেমাঝে বাড়ি ভাড়া দিতে দেরী করে । একি ফ্ল্যাটে থাকা সত্ত্বেও রিপনের সাথে আমার খুব একটা বেশি কথা হয়না ।
তন্ময়রা বলছে “একদিন আমাদের মাঝে তাকে নিয়ে আয় । বুয়েট-ডিইউ পর্যন্ত সিধা করে ফেলছি ।” তার ধারনা আমাদের আড্ডায় আসলে সে পূর্ণ জীবন সম্পর্কে শিক্ষা পাবে । হাসিঠাট্টা করতে করতে একদিন আসলেই রিপনকে বলে বসলাম ।
– তোমার ছুটি কবে কবে থাকে.. আমরা এই ব্রীজে সন্ধায় বসি । পড়াশোনার ফাঁকে তুমি যেতে পার ।
– জ্বী ভাই ।
– শোন ! ঈদে বাড়ি যাচ্ছ না কেন?
– বাবা নিষেধ করল । খুব একটা তো ছুটি পাইনি ।
আমি কোরবানী নিয়ে তাকে আর বেশি ঘাটালাম না, ছেলেটা অনেক সংকোচে আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল । “আজব কিসিমের..”
সন্ধায় চুপ করে আমাদের গল্প শুনছিল রিপন । এক মুহূর্তের জন্য তাকে হাসতে দেখলাম না । টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, আমি বিদায় নেবার প্রস্তুতি নিলাম । রিপন গলির মোড়ের দোকানটার নিচে দাড়িয়ে আছে । বৃষ্টি তখন ভালোই শুরু হইছে ।
– এইভাবে আর দাড়ায় থাকা যাবেনা । ভিজবি?
– চলেন ভাই ।
এই প্রথমবারের মত আমি তার মধ্যে আগ্রহ আর কিঞ্চিৎ আনন্দের ছাপ দেখতে পেলাম । আমরা কালাচাঁদপুর বস্তির পাশে হাটছি । দুজনই ভিজে একাকার ।
– দেখ ! একটা মেয়ে আর একটা ছেলে যখন এক সাথে বৃষ্টিতে হাটে, তখন বেপারটা রোমান্টিক মনে হয় । তোর কি মনে হয় আমরা যে ইচ্ছে করে ভিজছি, মানুষ ভাবছে আমরা কষ্টে আছি?
রিপন চুপ করে আছে । চোখের পানি নাকি বৃষ্টির পানি কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা ।
– তুই জানিস, আমি ভিজছি ঐ মানুষগুলোর কষ্ট বোঝার জন্য ।
আমরা দুজনে ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলাম । মাথা গোজার ঠাঁই নেই বলে তারা আমাদের মত বৃষ্টিবিলাসী হয় না । রিপন আমাকে উপেক্ষা করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে । তারপর নিজে নিজেই বলতে শুরু করে.. “আমার বৃষ্টিস্নাত হওয়ার একটা কারন আছে অবশ্য । মা সবসময় আমাকে বকা দিত, বলত চিকিৎসার টাকা আছে তোর! যে বৃষ্টিতে ভিজবি” বলতে বলতে রিপন কেঁদে দিল । “সে চলে যাওয়ার সময় আমিও ভিজেছিলাম.. চোখের বৃষ্টিতে । তাকে মনে করার জন্য আজ আপনার সাথে ভিজছি” ।
আমি রিপনকে জড়িয়ে ধরলাম । তাকে টেনে শেডের নিচে দাড়ালাম । আমাদের দৃষ্টি পানিতে ঝাপসা হয়ে গেছে । বাসায় ফেরার রাস্তাটা একবার শেষবারের মত দেখে নিলাম ।
৬বছর পর বদলে যায়নি আমাদের আড্ডাস্থল । শামীমের দোকানে লেগেছে এক নতুন টুল । মঈন গতবছর বিদেশে চলে গেছে । বাকিদের সাথে আমার তেমন দেখা হয় না । ঢাকায় আছে সব । তন্ময় বিয়ে করেছে গত বছর হল আর সোহাগের বাচ্চা হইছে বেশিদিন হয়নাই । সুতরাং এইরাস্তায় যতটুকু পরিবর্তন তা তো মানতেই হবে । রিপনের পরিশ্রম আর চেষ্টা তাকে অনেকদূর নিবে সেটা আমি জানতাম । সে বিন্দুমাত্র ভুল হতে দেয়নি তাতে । সুট-টাই পরে এই গলির সামনে সে থামে । গাড়ি থেকে নেমে ঐটুকু রাস্তায় সে হেঁটে বেড়ায় । কখনও বৃষ্টিতে ভিজে, মায়ের স্মৃতিতে অশ্রুসিক্ত হয় । তারপরও বৃষ্টিবিলাসী রিপন আনন্দ নিয়েই বেঁচে থাকার স্বপ্ন খোঁজে । কারন এই বিলাস এখন আর তার একার নয়, সবার সাথে হাসনাহেনার গন্ধে সুবাসিত হওয়ার বিলাস । বস্তি ভেঙে সেখানে গড়ে উঠেছে সুখের আশ্রয়স্থল । ছোট ছোট ছেলেরা স্কুলে পড়তে যায় । রিপনের টাকায় এখানে পরিবর্তন হয়ে গেছে জীবনযাপন; শিক্ষা ও চিকিৎসারও । জায়গাটার নাম হয়ে গেছে “বৃষ্টিবিলাস”..